বাংলাদেশে বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২১ মাস পর, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ নামে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
আগের বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসকে-বিডিআর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১০ সালের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন নামে নতুন একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে।
ওই আইনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধ এবং এ সম্পর্কিত কার্যাবলী সম্পাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ রাইফেলস পুনর্গঠন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা, শৃঙ্খলা ও রক্ষনাবেক্ষণের জন্য এই আইন প্রণীত হলো।
এর আগে ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেছিল।
সে ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্তকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকেও হত্যা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সেনাবাহিনী ও আনসার বাহিনীতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটলেও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নৃশংসতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
এ ঘটনার পর বাহিনীটির নাম, লোগো ও পোশাক পরিবর্তন ছাড়াও পুরো বাহিনীকেই পুনর্গঠন করা হয়েছিল।
বিডিআর বিদ্রোহের একদিন পরেই বিডিআর এর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ করা হয় তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মইনুল ইসলামকে। যিনি পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর লেফট্যানেন্ট জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন।
জেনারেল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে যেহেতু সেনাবাহিনীর ৫৭ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল তাই সেসময় সেনাবাহিনীর মধ্যে আবেগ আর নেতিবাচক চিন্তা ছিল বিজিবি-কে নিয়ে।
এমনকি সেসময় তৎকালীন বিডিআরকে নিষিদ্ধ করে দিয়ে সেনাবাহিনী যাতে সীমান্তের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এমন চিন্তাও ছিল বলে জানান মি. ইসলাম।
যেভাবে পুনর্গঠন করা হলো
সেসময় তৎকালীন বিডিআরকে পুনর্গঠনে যারা কাজ করেছিলেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল ইসলাম।
তিনি বলেন, বিজিবির ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করেই তখন এই বাহিনীর পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়।
এই কাজে সেনাবাহিনী এবং সামরিক প্রশাসন থেকে কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রাথমিক কাজ ছিল বিজিবির সম্ভাব্য পরিবর্তন নিয়ে একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করা।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিদের কাছে এই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় তাদের মতামত জানার জন্য। এর মধ্যে ছিলেন সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম শ্রেণীর কর্মকর্তা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আনসার বাহিনীর সদস্য এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি।
এছাড়া যারা স্বেচ্ছায় এই প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে মত দিতে চেয়েছেন তাদের সবার কাছেও তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিল বলে জানান মি. ইসলাম।
এই প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে উঠে আসা মতামতের ভিত্তিতেই বিজিবির ভবিষ্যতে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, যারা মত দিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই বলেছিলেন যে, বিজিবি থাকা উচিত এবং সীমান্তের দায়িত্ব তাদেরই পালন করা উচিত। তবে সেখানে নানা সংস্কার আসতে পারে।
তাঁর মতে, বিজিবির পুনর্গঠনের সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ক্ষোভ লাঘব করে পুনর্গঠন এগিয়ে নেয়া। সেসময় তারা নামে-বেনামে অনেক চিঠি পেয়েছেন উল্লেখ করে মি. ইসলাম বলেন, যেসব চিঠিতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন সেগুলো আমলে নিয়েছিলেন তারা।
সেনা কর্মকর্তা সংযুক্তিতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন
দুই হাজার নয় সালে বিডিআর বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল ওই বাহিনীর উচ্চপদে সেনা কর্মকর্তাদের সংযুক্তি। বিদ্রোহের পর এই বাহিনীকে কাঠামোগতভাবে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হলেও উচ্চপদে সেনা কর্মকর্তাদের সংযুক্তির বিষয়টিতে কোন পরিবর্তন আসেনি।
যেমন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের যে আইন রয়েছে সেখানে দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর প্রধান হিসেবে একজন মহাপরিচালক থাকবেন যিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে প্রেষনে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে নিযুক্ত হবেন।
মি. ইসলাম বলেন, যে কারণে বিডিআর বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে তার জন্য সেনাবাহিনী থেকে কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
তিনি জানান, সেনা কর্মকর্তাদের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য বিজিবির পুনর্গঠনের সময় একটি বই তৈরি করা হয়েছিল। এই বই পড়া ছাড়া এবং বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর কৃতকার্য হওয়া ছাড়া কোন সেনা কর্মকর্তা বিজিবিতে সংযুক্ত হতে পারে না।
আইন প্রণয়ন
মি. ইসলাম বলেন, বিজিবির পুনর্গঠনের পর এই বাহিনীতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন ২০১০ প্রণয়ন।
তিনি বলেন, বিজিবি একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। আর বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রতিটি সুশৃঙ্খল বাহিনী দেশের আইন ছাড়াও নিজস্ব প্রণীত আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিজস্ব আইন থাকলেও বিজিবির কোন নিজস্ব আইন ছিল না।
সংবিধানে সুশৃঙ্খল বাহিনী বলতে সেইসব বাহিনীকে বোঝানো হয় যারা সশস্ত্র বাহিনী বা যারা অস্ত্র নিয়ে থাকে। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন কালে বিজিবিও অস্ত্র নিয়েই থাকে।
মি. ইসলাম বলেন, তারা যে প্রশ্নপত্র তৈরি করেছিলেন সেখানে বিজিবির জন্য আলাদা নতুন আইন প্রণয়নের পক্ষে মত আসে। এছাড়া সেখানে বিজিবির নাম পরিবর্তন করার পক্ষেও মত আসে।
এর প্রেক্ষিতে বিজিবির জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করা হয় এবং তা কার্যকর করা হয়।
আপিলের সুযোগ
মি. ইসলাম বলেন, সামরিক বাহিনীর নিজস্ব যেসব আইন রয়েছে সেখানে আপিলের কোন সুযোগ এর আগে ছিল না।
কিন্তু বিজিবির জন্য ২০১০ সালে যে নতুন আইনটি প্রণয়ণ করা হয়েছে সেখানে আপিলের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এই আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে যে, চাকরী থেকে বরখাস্ত, অসামরিক কারাগারে ভোগযোগ্য যে কোন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ড, যাবজ্জীজন কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ক্ষেত্রে আপীল করতে পারবেন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
মি. ইসলাম বলেন, এই বিষয়টি বিজিবির সদস্যরা খুব ভালভাবে গ্রহণ করেছে। কারণ এখানে যেকোন শাস্তির বিরুদ্ধে একটা করে আপিল করার জায়গা রয়েছে।
বিকেন্দ্রীকরণ
বিজিবির পুনর্গঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ করা বাহিনীর সাবেক মহাপরিচালক লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল ইসলাম বলেন, মতামত জরিপে বিজিবির বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে অনেক মত এসেছিল।
সেই মতের প্রেক্ষিতেই বিজিবির অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়। সেই সাথে এই বাহিনীর সক্ষমতাও বাড়ানো হয়।
মি. ইসলাম বলেন, পুনর্গঠনের আগে বিজিবির প্রশাসনিক কাঠামো ছিল এরকম-প্রথমেই বিজিবির সদরদপ্তর, তারপর সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন।
এক্ষেত্রে সীমান্তে যদি কোন ঘটনায় অতিরিক্ত সীমান্তরক্ষী মোতায়েন করার প্রয়োজন হতো তাহলে ঢাকা থেকে বাহিনী পাঠানো হতো।
এমন পরিস্থিতি থেকে বিজিবির আঞ্চলিক একটি লেয়ার বা স্তর গঠন করা হয়।
বর্তমানে আঞ্চলিক সদরদপ্তরের অধীনে সেক্টর থাকে। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে বিজিবির চারটি রিজিয়ন বা অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের অধীনে তিন থেকে চারটি সেক্টর থাকবে।
“তাহলে ডিজির( বিজিবির মহাপরিচালক) জন্য সুবিধা, সে চারটা রিজিয়নের সাথে কথা বলবে।”
এই রিজিয়ন বা আঞ্চলিক সদরদপ্তরের অধীনে বর্তমানে রিজার্ভ বাহিনী রয়েছে। আবার সেক্টরের অধীনেও রিজার্ভ বাহিনী রয়েছে।
কোন সংকট দেখা দিলে প্রথমে সেক্টরের রিজার্ভ ফোর্স, তারপরে রিজিয়নের রিজার্ভ ফোর্স এবং সবশেষে প্রয়োজন হলে ঢাকা থেকে ফোর্স পাঠানো হয়।
মি. ইসলাম বলেন, “এ ধরণের পরিবর্তনগুলি আসলে সেই কোয়েশ্চেনেয়ারের (প্রশ্নপত্র) মাধ্যমেই কিন্তু আমরা বিভিন্ন মতামত নেয়ার ফলে বিজিবির একটা সার্বিক পুনর্গঠনের বিষয়টি, সেটা সেখান থেকেই উঠে আসে।”