মুসলিম গণহত্যা: ইতিহাসের সাক্ষীতে প্যারিসে আলজেরিয়দের গণহত্যার খবর ধামাচাপা দেবার কাহিনি

আলজেরিয়া ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল ১৯৬২ সালে। যখন এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউ তুঙ্গে, তখন প্যারিসের রাস্তায় প্রতিবাদীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফরাসি পুলিশ – চালিয়েছিল নির্মম গণহত্যা।

তারিখটা ছিল ১৭ই অক্টোবর ১৯৬১। ফ্রান্সে তখন আলজেরিয়রা প্রতিদিন ভয়ভীতি, হয়রানি আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

আলজেরিয়ান স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলনও চলছে পুরোদমে। সেই পটভূমিতে প্যারিসে শুধু আলজেরিয় মুসলিমদের টার্গেট করে প্রশাসন রাত্রিকালীন কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নেয়।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাতে ১৭ই অক্টোবর ৩০ হাজার ফরাসি আলজেরিয় জড়ো হন প্যারিসের কেন্দ্রে।

এদের মধ্যে ছিলেন ১৫ বছরের কিশোরী ফাতেমা বেডার। বাবা-মার নিষেধ অমান্য করে তিনি লুকিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ওই প্রতিবাদে।

তার ছোট ভাই জোডির বয়স তখন পাঁচ। সেই ভয়াবহ দিনের ঘটনা নিয়ে বিবিসির জান্নাত জলিলের সঙ্গে কথা বলেন জোডি।

“আমার বড় বোন ছিল আমার দ্বিতীয় মা। সে সবসময় আমার সাথে থাকত,” বলছিলেন জোডি। “আমি ছোট ছিলাম বলে বোন আমার দেখাশোনা করত। আমার বাবামাকে সবসময় সাহায্য করত। প্রতিদিন সকালে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেত। তার গায়ের রং ছিল কালো – মাথার চুল ছিল লম্বা।”

প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদানকারীরা ছিলেন ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আলজেরিয়ার মুক্তির আদর্শে অনুপ্রাণিত। কিশোরী ফাতেমাও স্বাধীন আলজেরিয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

ওই সমাবেশের দিনকয়েক আগেই আলজেরিয়ার স্বাধীনতাকামী দল এফএলএন-এর সদস্যদের হাতে নিহত হয় ১১জন ফরাসি পুলিশ। এর জবাবে প্যারিসে শুধুমাত্র আলজেরিয়ান মুসলিমদের ওপরই রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়।

আলজেরিয়ায় ১৩০ বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের দাবিতে এফএলএন গোষ্ঠীর লড়াই তখন সাত বছরে পড়েছে। ফ্রন্ট দ্য লিবারেশিওঁ ন্যাশিওনাল বা এফএলএন স্বাধীনতার দাবিতে আলজেরিয়ায় যে আন্দোলন চালাচ্ছিল তার ঢেউ তখন ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডেও পৌঁছে গেছে এবং ফ্রান্সে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু পুলিশ।

কিন্তু প্যারিসে শুধু আলজেরিয়দের টার্গেট করে কারফিউ জারির পর এফএলএন প্যারিসে তাদের আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে। ফ্রান্সের আলজেরিয় পরিবারগুলোকে তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নেবার আহ্বান জানায়। তাদের ধারণা ছিল প্রতিবাদে নারী ও শিশুরা অংশ নিলে পুলিশ সহিংসতা বর্জন করবে।

ঐতিহাসিক জঁ লুক ইনওডি বলছেন, ওই প্রতিবাদ বিক্ষোভের আগে থেকেই ফরাসি পুলিশ নিয়মিতভাবে আলজেরিয়দের হত্যা করছিল।

সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে প্রায়ই জঙ্গলে, নদীতে, খালবিলে আলজেরিয়দের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছিল।

এরপর সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে আর অক্টোবরেও পুলিশ প্যারিসে আলজেরিয়দের ধরপাকড় করতে থাকে। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো স্যেন নদীর পাড়ে। সেখানে তাদের অজ্ঞান করে, হাত বেঁধে রাতের বেলা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো আর সবসময় সেটা করা হতো রাতের অন্ধকারে।

জঁ লুক ইনওডি অনেক বছর ধরে কী ঘটেছে সেই সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালা থেকে তাকে তথ্য সংগ্রহ করতে দেয়া হয়নি। তারপরেও তিনি ১৯৯১ সালে ওই গণহত্যার ওপর তার একটি বই প্রকাশ করেন।

তার বইতে তিনি সেই সময়ের কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিস্তারিত সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন।

প্রতিবাদ সমাবেশের পরদিন ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানায়, সেদিনের ঘটনায় মারা গেছে দুজন আলজেরিয়। কিন্তু জঁ লুকেই নওডির গবেষণায় বেরিয়ে আসে যে শুধু প্রতিবাদের রাতেই মারা গেছে দুশ’ মানুষ। এছাড়াও সমাবেশের আগে ও পরে পুলিশের হাতে প্রাণ হারায় আরও বহু মানুষ।

ঐতিহাসিক মি. ইনওডি বিবিসিকে জানান, ঘটনার দিন প্রতিবাদকারীরা প্যারিসের কেন্দ্রে এসে পৌঁছেছিল সন্ধ্যেবেলা।

“শান্তিপূর্ণ আর ভাবগম্ভীর একটা সমাবেশে যোগ দেবার জন্য তারা বেড়াতে যাবার সুন্দর পোশাকে সেজে এসেছিল। তারপরও পুলিশ তাদের অনেককে আটক করে এবং তাদের সঙ্গে খুবই সহিংস আচরণ করে। কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয় আটক কেন্দ্রে,” বলেন মি. ইনওডি।

এরপরেও বহু পুরুষ, নারী ও শিশু মূল সড়কের ওপর কোনরকম ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল।

“পুলিশ আচমকাই বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়, তাদের হত্যা করে। কাছেই আরেকটি সেতুর ওপরেও বিক্ষোভ সমাবেশ করছিল কয়েক হাজার মানুষ। তাদের ওপরেও চলে গুলিবর্ষণ। সেখানে শুরু হয় নদীতে লাশ ফেলার ঘটনা। পুলিশ অনেকগুলো ব্রিজ থেকে বিক্ষোভকারীদের লাশ স্যেন নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।”

একটা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রূপ নেয় গণহত্যায়। ধারণা করা হয় পুলিশ অন্তত একশ’ প্রতিবাদকারীকে হত্যা করে।

ফাতেমার বাবা-মা এধরনের সহিংসতার আশঙ্কায় মেয়েকে সেদিন প্রতিবাদ সমাবেশে যেতে দিতে চাননি। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ফাতেমা লুকিয়ে প্রতিবাদে যোগ দিতে গিয়েছিল। সে আর ফেরেনি।

দু সপ্তাহ ধরে মেয়েকে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন তার বাবা মা, তাদের সঙ্গে ছিলেন পাঁচ বছরের জোডি।

“আমার মনে আছে ১৫ দিন আমার মা প্রতিদিন আমার হাত ধরে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন আমার বোনের খোঁজে। মা আমাকে কেন নিয়ে যেতেন জানি না। কিন্তু দেখতাম মা সবসময় দোয়া করছেন আর কাঁদছেন,” বলছিলেন জোডি।

অবশেষে পুলিশ ফাতেমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায় স্যেন নদীর পাশে নদীটিরই এক অংশ সেন্ত দেনি খালে তারা ৩১শে অক্টোবর এক কিশোরীর মৃতদেহ পেয়েছে। পুলিশ বলে তাদের সন্দেহ কিশোরীটি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

কিন্তু ওই খালের একই অংশ থেকে পুলিশ আরও ১৪জন আলজেরিয়র মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল।

জোডি বলেন তার বাবা যখন ফাতেমার লাশ শনাক্ত করতে যান, তখন পুলিশ তার বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।

“আমার বাবা সেখানে পৌঁছলে পুলিশ তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়, তাকে অপমান করে। বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহার করে বাবাকে গালাগালি করে। বাবা বড় একটা ঘরে ঢুকে দেখেন সেখানে মেঝেতে ১৫টি লাশ রাখা আছে। এর মধ্যে আমার বোনের লাশ বাবা চিনতে পারেন, তার লম্বা কালো চুল দেখে। পনের দিন পানিতে ডুবে থাকায় তার মুখ আর চেনা যাচ্ছিল না,” বলছিলেন জোডি।

অনেকেই জানত কী ঘটছে, কিন্তু কেউ মুখ খুলত না। বিপুল সংখ্যায় আলজেরিয়দের জোর করে তখন তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল।

বেশ কিছু পুলিশ অফিসার এবং সাংবাদিক এই অন্যায় বন্ধ করতে চাইতেন, কথা বলতে চাইতেন। কিন্তু একটা নিরবতার দেয়াল তুলে দেয়া হয়েছিল বলে জানান জঁ লুক ইনওডি।

মি. ইনওডি বলেন বহু বছর এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের খবর প্রায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়, এর কারণ ছিল সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট দি গ্যল সরকারের ব্যাপক চাপ।

“প্রথমত যেসব সাংবাদিক ঠিকমত রিপোর্ট করতে চেয়েছিল তাদের বাধা দেয়া হয়। ছবি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়। যেসব সাংবাদিক খোঁজখবর নিতে শুরু করেন, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। যাতে তারা রিপোর্ট করতে না পারে তার জন্য সবরকম পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিছু সাংবাদিক শুধুই সরকারি ভাষ্য প্রকাশ করে।”

ঘটনাচক্রে এই গণহত্যার হোতা ছিলেন সেসময় প্যারিসের পুলিশ প্রধান মরিস প্যাপঁ। কয়েক দশক পর এই ঘটনার কথা ফ্রান্সের বিচার বিভাগের সামনে তাকেই তুলে ধরতে হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের ইহুদিদের নাৎসী মৃত্যু শিবিরে পাঠানোর দায়ে মি. প্যাপঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয় ১৯৯৭ সালে। ওই মামলা চলার সময় জঁ লুক ইনওডি সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে ১৯৬১ সালে প্যারিসে আলজেরিয় বংশোদ্ভুতদের গণহত্যার জন্য তিনি মি. প্যাপঁ-র বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ আনেন । মরিস প্যাপঁ মি. ইনওডির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন এবং হেরে যান।

“সাবেক পুলিশ প্রধান মরিস প্যাপঁ আমার বিরুদ্ধে মামলা লড়ে হেরে যান ১৯৯৯ সালে, কারণ আমি সংবাদপত্র লেমঁন্ড-এ লিখেছিলাম মি. প্যাপঁ-র নির্দেশে পুলিশ আলজেরিয় মুসলিমদের ব্যাপকহারে হত্যা করেছিল। সরাসরি জড়িত ছিলেন, এমন অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম যাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই।

“আমি অনেক দলিলপত্র উপস্থাপন করেছিলাম। কৌঁসুলিকে মানতে হয়েছিল যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। গণহত্যা যে সংঘটিত হয়েছিল সেই প্রথম তা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয়,” বলেন ঐতিহাসিক জঁ লুক ইনওডি।

জোডির মত ফরাসি আলজেরিয় পরিবারগুলোর জন্যও সেটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কারণ তারা নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলেন যে কোনদিন তারা এই অন্যায়ের বিচার পাবেন না- এমনকি ওই অপরাধের কথাও কোনদিন স্বীকার করা হবে না। তবে অপরাধীদের কোন সাজা হয়নি।

জোডির বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের হয়ে লড়াই করেছিলেন। ফ্রান্সের পুলিশের হাতে তার মেয়ের নির্মম মৃত্যুর আঘাত তিনি মানতে পারেননি। জোডি বলেন তারা বাবা এনিয়ে কথা বলতেন না।

“আমাদের পরিবারের জন্য এটা ছিল বিরাট আঘাত। আমার বোনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে তারা কোন কথা বলতে চাইতেন না। তাদের কষ্ট আমরা বুঝতাম। আমরাও মায়ের কান্না আর দেখতে চাইতাম না।”

উনিশশ নব্বইয়ের দশকের শেষে ফরাসি কর্তৃপক্ষ অবশেষে আলজেরিয় মুসলিমদের ওই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল বলে স্বীকার করে।

কিন্তু এরপরেও তারা বলে যে ঘটনায় মারা গিয়েছিল মাত্র ৪৮ জন।

আসলে পুলিশ কতজনকে হত্যা করেছিল তার সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন ওই একদিনে ২০০ থেকে ৩০০ আলজেরিয়কে হত্যা করা হয়।

ঐতিহাসিকরা বলেন ১৭ই অক্টোবরের সমাবেশের পরের কয়েক দিনে এবং কয়েক সপ্তাহে স্যেন নদীর তীরে ভেসে এসেছিল ১১০টি লাশ। গুলি করে হত্যা করার পর কারও কারও লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

আহতদেরও নদীর ঠাণ্ডা জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। নদীতে ডুবে তাদের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের মধ্যে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন ফাতেমা বেদার।

নদীতে ফেলে দেয়া নিহত বহু ফরাসি আলজেরিয়র স্মৃতিতে ২০০১ সালে প্যারিসে স্যেন নদীর ওপর শেন মিশেল ব্রিজে একটি স্মৃতিফলক বসানো হয়।

প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এই গণহত্যার নিন্দা জানান, কিন্তু ফরাসি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই হত্যাযজ্ঞের জন্য কোন দু:খ প্রকাশ তিনি করেননি।

(সংবাদ উৎস: BBC – বাংলা )

Top